রামায়ণ পড়তে গেলে রাবণ চরিত্রটি নিয়ে আমাদের অনেক প্রশ্ন উঠে আসে। তিনি ছিলেন দশমুখী লঙ্কেশ্বর, একাধারে জ্ঞানী, ভক্ত, কিন্তু একই সাথে ছিলেন কঠোর এবং ক্ষমতালোভী। আজ আমরা বিশ্লেষণ করব, রাবণকে কীভাবে বোঝা যায়—তিনি কি কেবল উগ্রবাদী শাসক ছিলেন, নাকি তার মধ্যে অন্য কোনো দিকও ছিল যা আমাদের শেখার যোগ্য?
রাবণের শক্তি এবং জ্ঞান
যদি রাবণের শক্তির কথা বলি, তাহলে তা ছিল অসামান্য। তিনি ছিলেন এক মহাপরাক্রমশালী শাসক, যিনি সমগ্র লঙ্কাকে স্বর্গের মতো সাজিয়েছিলেন। তবে তার সবচেয়ে বড় গুণ ছিল তার জ্ঞান। বালকাণ্ডে বর্ণিত হয়েছে, রাবণ ছিলেন চতুর্বেদ পণ্ডিত। তার সঙ্গীতপ্রতিভা এবং তন্ত্র-মন্ত্রের ওপর দখল ছিল অতুলনীয়।
একটি উদাহরণ হলো তার শিবের প্রতি ভক্তি। যখন রাবণ কৈলাস পর্বত উত্তোলন করতে গিয়ে ব্যর্থ হন, তখন তিনি শিবের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন এবং এক নতুন সঙ্গীত রচনা করেন, যা পরিচিত হলো “শিবতাণ্ডব স্তোত্র” নামে। এটি আজও ভক্তিমূলক সংগীত হিসেবে সমাদৃত।
তবে প্রশ্ন হলো, এত বিদ্যা এবং শক্তি থাকা সত্ত্বেও রাবণ কেন নিজের পতন ঠেকাতে পারলেন না?
রাবণের অহংকার
রাবণের মূল সমস্যা ছিল তার অহংকার। অরণ্যকাণ্ডে আমরা দেখি, সীতাকে অপহরণ করার পেছনে তার অহংকারই প্রধান ভূমিকা পালন করেছিল। নিজের বোন শূর্পণখার অসম্মানকে প্রতিশোধ নিতে তিনি সীতাকে অপহরণ করেন।
একটি ঘটনা এখানে উল্লেখযোগ্য। যখন রাবণ সীতাকে অপহরণ করে লঙ্কায় নিয়ে যান, তখন সীতা তাকে বোঝানোর চেষ্টা করেন যে, “ধর্মের পথ ছেড়ে তুমি যদি এমন কাজ করো, তবে তোমার পতন নিশ্চিত।” কিন্তু রাবণ তার অহংকারের কারণে কোনো কথাই শোনেননি। এই অহংকারই তাকে এমন পর্যায়ে নিয়ে যায় যেখানে তার নিজের ধ্বংস অনিবার্য হয়ে ওঠে।
রাবণ কি শুধুই উগ্রবাদী ছিলেন?
আপনি যদি রাবণকে কেবল উগ্রবাদী বলেই চিহ্নিত করেন, তাহলে হয়তো তার অন্য দিকগুলো উপেক্ষা করছেন। উদাহরণস্বরূপ, যুদ্ধকাণ্ডে আমরা দেখি, রাবণ যুদ্ধের সময় এক চমৎকার শাসকের ভূমিকা পালন করেছেন। তিনি তার সেনাপতিদের প্রতি সদয় ছিলেন এবং তাদের সাহস জোগাতেন। তার আদেশ এবং যুদ্ধকৌশল ছিল প্রশংসনীয়।
আরেকটি ঘটনা থেকে বোঝা যায়, রাবণ শুধুই হিংস্র ছিলেন না। যখন তিনি লক্ষ্মণকে অচেতন অবস্থায় দেখেন, তখন তিনি নিজের চিকিৎসক সুশেনকে তাকে সুস্থ করার নির্দেশ দেন। এমন একটি কাজ একজন উগ্রবাদীর পক্ষে করা সম্ভব নয়।
তাহলে, আপনি কী ভাবছেন? রাবণ কি সত্যিই পুরোপুরি খারাপ ছিলেন, নাকি তার মধ্যে ছিল কিছু মানবিক দিক?
রাবণের পতনের কারণ
রাবণের পতনের সবচেয়ে বড় কারণ ছিল তার নীতিবর্জিত কর্ম। সুন্দরকাণ্ডে বর্ণিত হয়েছে, যখন হনুমান রাবণের দরবারে আসেন, তখন রাবণ তাকে হত্যা করার চেষ্টা করেন। তার মন্ত্রীরা যখন বলেন, “দূত হত্যা করা ধর্মবিরুদ্ধ,” তখন রাবণ সেই কথা মানতে রাজি হননি।
আরেকটি কারণ ছিল তার নারীদের প্রতি অশ্রদ্ধা। সীতার প্রতি তার অবজ্ঞা এবং তাকে দখলের বাসনা তার পতনের প্রধান কারণ। রামায়ণ আমাদের শিক্ষা দেয়, “যে ব্যক্তি নারীদের সম্মান করে না, সে কখনোই শাসক হিসেবে সফল হতে পারে না।”
রাবণের কাছ থেকে আমরা কী শিখতে পারি?
রাবণ ছিলেন এক জটিল চরিত্র। তার জীবন আমাদের শিখিয়ে দেয় যে, জ্ঞান, শক্তি এবং প্রতিভা থাকার পরও যদি আমরা অহংকার এবং লোভের পথে যাই, তবে ধ্বংস অনিবার্য। রাবণের জীবনের প্রতিটি অধ্যায় আমাদের সতর্ক করে দেয়—“ধর্মের পথই একমাত্র সঠিক পথ।”
শেষ কথা
রাবণ কি শুধুই উগ্রবাদী ছিলেন? এই প্রশ্নের উত্তর নির্ভর করে আপনি তাকে কীভাবে দেখছেন তার ওপর। তার জীবন থেকে আমরা যেমন ক্ষমতার অপব্যবহার না করার শিক্ষা পাই, তেমনই পাই ধর্ম এবং ন্যায়ের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়ার প্রয়োজনীয়তা।
আপনি কি কখনো ভেবেছেন, রাবণ যদি অহংকার ত্যাগ করে ধর্মের পথে থাকতেন, তবে তার পরিণতি কেমন হতো? রামায়ণ আমাদের শেখায়, সঠিক পথ অনুসরণ করাই জীবনের প্রকৃত লক্ষ্য। আপনি কি সেই পথে হাঁটছে