রামায়ণ—আমাদের প্রাচীন ধর্মীয় মহাকাব্য। এর প্রতিটি পাতা যেন নীতিশিক্ষা আর জীবনের গভীর দর্শন দিয়ে ভরা। তবে রামায়ণের একটি বিশেষ দিক নিয়ে আজ আমরা আলোচনা করব: নারী এবং পুরুষের ভূমিকা। আপনার মতো আমিও প্রায়ই ভাবি, সত্যিই কি রামায়ণে নারী এবং পুরুষকে সমানভাবে দেখানো হয়েছে? আজ এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজব কিছু উদাহরণ আর শ্লোকের আলোকে।
সীতা: এক মহীয়সী নারীর প্রতীক
রামায়ণের কেন্দ্রীয় নারীচরিত্র সীতা। তিনি শুধু এক আদর্শ স্ত্রীই নন, তাঁর চরিত্রে আমরা দেখতে পাই অপরিসীম সাহস, ধৈর্য এবং আত্মত্যাগের উদাহরণ। লঙ্কায় বন্দি অবস্থায়, রাবণের সমস্ত প্রলোভন প্রত্যাখ্যান করে সীতা নিজের সতীত্ব রক্ষা করেছেন। তাঁর এই দৃঢ়চেতা মনোভাবের কথা রামায়ণে বলা হয়েছে:
“ধর্মপত্নী সীতামহা, সতীত্যাগেন ন যযৌ।”
— অর্থাৎ সীতা তাঁর সতীত্বের পথে অটল ছিলেন।
এখানে আপনি বুঝতে পারবেন, সীতাকে কেবল ভোগ্যপণ্য হিসাবে নয়, একজন স্বাধীনচেতা, শক্তিশালী নারীরূপে দেখানো হয়েছে।
রামের চরিত্রে দায়িত্ববোধের প্রতিফলন
রাম ছিলেন একজন আদর্শ পুরুষ, যিনি নিজের সুখ-দুঃখের চেয়ে সর্বদা ধর্ম আর দায়িত্বকে প্রাধান্য দিয়েছেন। যখন সীতাকে বনবাসে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিতে হলো, তা তাঁর হৃদয়কে ভেঙে দিয়েছিল। তবুও রাজধর্ম পালনের জন্য তিনি এই কঠিন সিদ্ধান্ত নেন। তাঁর সেই কষ্টের প্রতিফলন আমরা পাই এই শ্লোকে:
“জননীবৃত্তমো প্যাহং, রাজ্যস্যার্থং ন চ আত্মনঃ।”
— অর্থাৎ রাম বলেন, আমি নিজের সুখের জন্য নয়, রাজ্যের মঙ্গলার্থে কাজ করছি।
রামের দায়িত্বপরায়ণতা আমাদের শিখিয়ে দেয় যে জীবন কখনো কখনো কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করে।
মন্দোদরী: আরেক নারীর শক্তি
রাবণের স্ত্রী মন্দোদরী, রামায়ণের আরেক উল্লেখযোগ্য নারীচরিত্র। তিনি কখনোই রাবণের ভুলকে সমর্থন করেননি। বরং চেষ্টা করেছেন তাঁকে সঠিক পথে ফেরানোর। মন্দোদরীর চরিত্র আমাদের দেখায় যে, একজন নারীর ভূমিকা শুধুই পরিবার বা সমাজের উপর নির্ভর করে না। তিনি সঠিক সময়ে সঠিক পরামর্শ দিতে সক্ষম।
লক্ষ্মণ এবং তাঁর স্ত্রীর সম্পর্ক
লক্ষ্মণ এবং উর্মিলার সম্পর্কও একটি অনন্য উদাহরণ। যখন লক্ষ্মণ রামের সঙ্গে ১৪ বছরের জন্য বনবাসে গেলেন, উর্মিলা স্বেচ্ছায় গৃহে থেকে সমস্ত দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তিনি স্বামীকে সমর্থন করার জন্য যে ত্যাগ স্বীকার করেছিলেন, তা সত্যিই প্রশংসনীয়।
সমানত্বের সূক্ষ্ম বার্তা
রামায়ণ সরাসরি নারী-পুরুষের সমানত্বের কথা না বললেও, এর প্রতিটি চরিত্রের মধ্যে দিয়ে আমরা এই বার্তাটি পাই। সীতা যেমন রামের জন্য ত্যাগ স্বীকার করেছেন, তেমনই রামও সীতার জন্য অসীম কষ্ট সহ্য করেছেন। তাঁদের সম্পর্ক পারস্পরিক সম্মান ও ভালোবাসার এক অনন্য উদাহরণ।
উপসংহার:
আপনার মতে, রামায়ণ কি আদর্শ সমাজের প্রতিফলন? নারী এবং পুরুষের ভূমিকায় সমান দায়িত্ববোধ এবং ত্যাগের যে বার্তা রামায়ণ দেয়, তা কি আমরা আজকের জীবনে অনুসরণ করতে পারি? যদি পারি, তবে আমাদের জীবনও এক মহাকাব্যে পরিণত হতে পারে।