রামায়ণের সময় ধর্মের ভূমিকা কী ছিল?

রামায়ণ পড়তে গিয়ে এক জিনিস আমি স্পষ্টভাবে উপলব্ধি করেছি: ধর্ম আমাদের জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপকে পরিচালিত করে। আপনি কি কখনো ভেবে দেখেছেন, কীভাবে রামচন্দ্র নিজের ধর্মকে জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে পালন করেছেন? রামায়ণ আমাদের দেখিয়েছে, ধর্ম মানে শুধুমাত্র পূজা-অর্চনা নয়, বরং জীবনের সঠিক পথ অনুসরণ করা।

ধর্মের সংজ্ঞা রামায়ণের আলোকে

রামায়ণের গল্পে ধর্মকে কেবল নীতিশাস্ত্রের নিগূঢ় অর্থেই ব্যবহৃত হয়নি; বরং এটিকে জীবনের মৌলিক ভিত্তি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। “ধর্মো রক্ষতি রক্ষিতঃ” অর্থাৎ, ধর্মকে রক্ষা করলে ধর্ম আমাদের রক্ষা করে – এই মূলমন্ত্র রামচন্দ্রের চরিত্রে সর্বদা প্রকাশ পায়। তিনি নিজে ধর্মের পথ থেকে বিচ্যুত হননি, এমনকি কঠিন পরিস্থিতিতেও।

রামচন্দ্রের বনবাস

রামচন্দ্র যখন জানলেন যে তাকে রাজ্য ত্যাগ করে বনবাসে যেতে হবে, তিনি কি কোনো রকম প্রশ্ন তুলেছিলেন? না। তিনি নিজের পিতার কথা ও প্রতিজ্ঞাকে সম্মান জানিয়ে বনবাসে গিয়েছিলেন। এটা কি শুধু পিতৃভক্তি ছিল? না। এটি ছিল তার ধর্মের প্রতি অটল নিষ্ঠার পরিচয়। “পিতৃবাক্যং ধর্মস্য মূলম” – এই নীতিতে বিশ্বাসী রামচন্দ্র আমাদের শিখিয়েছেন, ধর্ম পালন করতে হলে ব্যক্তিগত সুখ-স্বার্থ ত্যাগ করতেও প্রস্তুত থাকতে হয়।

সীতার প্রতি ভালোবাসা ও দায়িত্ব

বনবাসকালে সীতার প্রতি রামচন্দ্রের ভালোবাসা এবং তার সম্মান রক্ষার জন্য তিনি যা করেছেন, তা ধর্মের আরেকটি উজ্জ্বল উদাহরণ। সীতাকে রক্ষা করতে তিনি রাবণের সঙ্গে যুদ্ধ করেছেন, যদিও জানতেন এটি কতটা কঠিন। তিনি বলেছিলেন, “স্ত্রীণাং ধর্মো রক্ষণং” – নারীর রক্ষা করা প্রতিটি পুরুষের ধর্ম। সীতার প্রতি তার দায়িত্ববোধ আমাদের শেখায়, ভালোবাসা মানে শুধু আবেগ নয়; এটি দায়িত্ব ও সম্মানের মিশ্রণ।

ভরতের রাজ্যশাসন

ভরত যখন রামচন্দ্রকে রাজ্যের সিংহাসনে বসানোর জন্য অনুরোধ করেন, রাম তা প্রত্যাখ্যান করেন। কেন? কারণ তার পিতা তাকে বনবাসের নির্দেশ দিয়েছিলেন। ধর্মের প্রতি তার এই আনুগত্য ভরতকেও গভীরভাবে প্রভাবিত করে। ভরত রামের পাদুকা নিয়ে রাজ্য শাসন করেন। এই ঘটনা আমাদের শেখায় যে ধর্ম মানে নিজের কর্তব্যের প্রতি নিষ্ঠা।

ধর্ম ও বন্ধুতা: সুগ্রীব ও হনুমান

রামচন্দ্রের বন্ধু হনুমান এবং সুগ্রীবও ধর্মের প্রতি তাদের আনুগত্য প্রকাশ করেছেন। সুগ্রীবের সঙ্গে বন্ধুত্ব করার সময় রাম তাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে তিনি বালি নামক অত্যাচারী রাজার হাত থেকে তাকে মুক্ত করবেন। রাম সেই প্রতিশ্রুতি পূরণ করেন। এটি ধর্মের আরেকটি মূল শিক্ষা তুলে ধরে – প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা। হনুমানের কথাই বা বলি না কেন? তিনি বলেছিলেন, “রাম কার্যে ক্রিয়ার্থং প্রানমপ্যরক্ষয়ামি” – অর্থাৎ রামের কাজে নিজের প্রাণও উৎসর্গ করতে প্রস্তুত। এমন নিঃস্বার্থ বন্ধুত্ব ধর্মেরই একটি রূপ।

রামায়ণের কয়েকটি বিখ্যাত উক্তি

  •  “ধর্মে স্বভবং শ্রেয়ঃ” – নিজের ধর্ম পালন করা শ্রেষ্ঠ।
  •   “সহানুভূতি সপ্সঙ্গা ধর্মস্য লক্ষণং” – সহানুভূতি ও একতার মাধ্যমে ধর্মের প্রকৃত রূপ প্রকাশ পায়। 
  •  “ত্যাগেন একং সুখং লভ্যতে” – ত্যাগের মাধ্যমে প্রকৃত সুখ লাভ হয়। 

 “জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরীয়সী” – মাতা ও মাতৃভূমি স্বর্গ থেকেও বড়।

বর্তমান জীবনে রামায়ণের শিক্ষা

আপনি কি ভেবে দেখেছেন, আজকের জীবনে এই শিক্ষাগুলো কতটা প্রাসঙ্গিক? আমরা প্রতিদিন বিভিন্ন দিক থেকে সমস্যার মুখোমুখি হই। কিন্তু রামের মতো যদি আমরা আমাদের কর্তব্যের পথে অবিচল থাকি, তবে জীবনের সব সমস্যার সমাধান সম্ভব।

আজকের পৃথিবীতে সম্পর্কের মান কমে যাচ্ছে। রামায়ণ আমাদের শেখায়, সম্পর্ক মানে দায়িত্ববোধ এবং প্রতিশ্রুতি। আপনার জীবনেও কি এমন কোনো পরিস্থিতি এসেছে, যেখানে আপনি সম্পর্কের কারণে নিজের ইচ্ছাকে ত্যাগ করেছেন? যদি হ্যাঁ হয়, তবে বুঝবেন আপনি রামচন্দ্রের দেখানো ধর্মের পথ অনুসরণ করছেন।

আপনার জীবনে ধর্মের ভূমিকা

রামায়ণ আমাদের জীবনযাত্রার প্রতিটি ক্ষেত্রে ধর্মের গুরুত্ব তুলে ধরে। আজ আমি আপনাকে একটি প্রশ্ন রেখে যেতে চাই: আপনি কি আপনার জীবনে ধর্মকে সেইভাবে অনুসরণ করছেন, যেভাবে রামচন্দ্র করেছেন? যদি না করে থাকেন, তবে আপনি কীভাবে তা শুরু করবেন? মনে রাখবেন, ধর্ম মানে কেবল ধর্মীয় রীতিনীতি নয়; এটি জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার চর্চা।

“ধর্ম অনুসরণ করুন, কারণ ধর্মই জীবনের প্রকৃত পথ।”

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top