কীভাবে রাম দরিদ্র শ্রেণির মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন?

কীভাবে রাম দরিদ্র শ্রেণির মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন?

রামায়ণ আমাদের শুধু ধর্মীয় গ্রন্থ নয়, এটি জীবনের একটি পথপ্রদর্শক। এতে এমন অনেক শিক্ষা রয়েছে যা আমাদের জীবনে সঠিক পথ দেখাতে পারে। কীভাবে সম্পর্ক তৈরি করতে হয়, কীভাবে অন্যদের সম্মান করতে হয়, কীভাবে বিনম্রতা বজায় রাখতে হয় – এই সবকিছুই রামায়ণ থেকে শেখা যায়। আজ আমরা কথা বলব কীভাবে ভগবান রাম দরিদ্র শ্রেণির মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন এবং তাদের সম্মান দিয়েছিলেন।

আমি জানি, আপনার মনে হতে পারে যে, রাজা হয়ে দরিদ্র মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক রাখা কি আদৌ সম্ভব? কিন্তু এইখানেই রামের অনন্যতা। তিনি ছিলেন সত্যিকারের রাজা, যিনি নিজের প্রজাদের ভালোবাসা অর্জন করেছিলেন।

 সবকিছুর উপরে বিনম্রতা

রামচন্দ্রের চরিত্রে সবচেয়ে বড় গুণ ছিল তাঁর বিনম্রতা। রামের জীবন থেকে আমরা শিখতে পারি যে সঠিক রাজা কখনও অহংকারের পথে হাঁটেন না। তাঁর চোখে সব মানুষ সমান ছিল, এবং এই বিশ্বাসেই তিনি দরিদ্র শ্রেণির মানুষের হৃদয় জয় করেছিলেন।

একবার ভগবান রাম, তাঁর বনবাসের সময়, শবরী নামে এক দরিদ্র বৃদ্ধার সঙ্গে দেখা করেছিলেন। শবরী ছিলেন এক অনাড়ম্বর, দরিদ্র মহিলা। কিন্তু তার ভক্তি ছিল অগাধ।

রামচন্দ্র শবরীর বাড়িতে গিয়ে তাঁর দেওয়া ফল গ্রহণ করেছিলেন। শবরী নিজের খাওয়া ফলগুলোই রামের সামনে পরিবেশন করেছিলেন, কারণ তিনি নিশ্চিত হতে চেয়েছিলেন যে ফলগুলো মিষ্টি। আজকের যুগে এটা অবিশ্বাস্য মনে হলেও, রাম কোনো সংকোচ না করেই সেই ফল গ্রহণ করেন। এই বিনম্রতা আমাদের শেখায় যে সত্যিকারের সম্পর্ক গড়তে হলে অহংকারকে দূরে সরিয়ে রাখতে হবে।

রামের এই আচরণের প্রসঙ্গে বাল্মীকির রামায়ণে লেখা আছে

বিনম্রতা ছাড়া ভক্তি অসম্পূর্ণ। যে বিনম্রতা জানে, সেই প্রকৃত ভক্ত।

 বন্ধুত্বের নিস্পৃহ সম্পর্ক

ভগবান রামের বনবাসের সময় তিনি শুধুমাত্র দরিদ্র শ্রেণির মানুষের সঙ্গে বন্ধুত্ব করেননি, তাঁদের জীবনে সান্ত্বনা ও সম্মান ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। এর একটি বড় উদাহরণ হল গুহ রাজা

গুহ ছিলেন এক সাধারণ নিষাদ সম্প্রদায়ের প্রধান। তিনি ছিলেন দরিদ্র শ্রেণির প্রতিনিধি। কিন্তু তাঁর সরলতা ও ভক্তি দেখে রামচন্দ্র তাঁকে নিজের বন্ধু হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন।

যখন রামচন্দ্র বনবাসের পথে ছিলেন, গুহ নিজে নৌকা চালিয়ে রাম, সীতা ও লক্ষ্মণকে গঙ্গা নদী পার করান। গুহের নৌকা ছিল দরিদ্রের প্রতীক, কিন্তু তাঁর হৃদয় ছিল বিশাল। রামচন্দ্র তাঁকে এমন শ্রদ্ধা দিয়েছিলেন যে গুহ নিজেকে ধন্য মনে করেছিলেন।

গুহের প্রতি রামের এই ভালোবাসা প্রমাণ করে যে সমাজে শ্রেণি বিভেদ থাকলেও ভালোবাসা ও সম্মানের ক্ষেত্রে কোনো পার্থক্য থাকে না।

হৃদয়ের বন্ধুত্ব শ্রেণি দেখে গড়ে ওঠে না, সে গড়ে ওঠে ভালোবাসা দিয়ে।

 কিষ্কিন্ধ্যার দরিদ্র বানরসেনাদের প্রতি ভালোবাসা

বানর রাজা সুগ্রীবের রাজ্যে রামচন্দ্র এমন এক সেনাবাহিনী তৈরি করেছিলেন, যাদের অধিকাংশই ছিল দরিদ্র। তাদের ছিল না কোনো রাজকীয় প্রতিপত্তি বা ধনসম্পদ। কিন্তু রামচন্দ্র তাঁদের প্রতি যে ভালোবাসা এবং সম্মান দেখিয়েছিলেন, তা সত্যিই অনন্য।

রাম কখনও তাঁদের শক্তির তুলনা করেননি; বরং তাঁদের প্রতি বিশ্বাস রেখেছিলেন। হানুমান, যিনি ছিলেন সুগ্রীবের অন্যতম অনুগামী, তিনি রামের প্রতি সেই বিশ্বাসের প্রতিদান দিয়েছিলেন।

রামের মুখে বারবার শুনতে পাওয়া যায় তাঁর সেনাদের প্রতি কৃতজ্ঞতার কথা। তিনি জানতেন যে শ্রীহীন সমাজেও অনেক মূল্যবান রত্ন লুকিয়ে থাকে। তাঁর এই বিশ্বাসই দরিদ্র বানরসেনাদের ভগবান রামের প্রতি একনিষ্ঠ করে তোলে।

যে মানুষ কর্মফল নিয়ে বিচার করে না, তার মতো ধনবান আর কেউ নেই।

 ভরত-মাতার প্রতি শূদ্রের অবদান

বাল্মীকির রামায়ণে আরেকটি ঘটনা পড়লে বোঝা যায়, কীভাবে রামের সময় দরিদ্র মানুষের অবদান ছিল অমূল্য। ভরত যখন রামের খোঁজে বনবাসে গিয়েছিলেন, তখন দরিদ্র শূদ্র সম্প্রদায়ের মানুষরাই তাঁদের পথ দেখিয়েছিল।

রামের প্রতি তাঁদের ভালোবাসা ছিল অকৃত্রিম। সমাজ তাদের নিচু চোখে দেখলেও, রাম ও তাঁর ভাইরা তাঁদের প্রতি চিরকালই শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। এমনকি শূদ্রদের সাহায্য ছাড়া রামের জীবনযাত্রা অসম্পূর্ণ থেকে যেত।

 রামের শিক্ষা আমাদের জীবনে

রামচন্দ্রের জীবন থেকে আমরা একটি বড় শিক্ষা পাই যে সমাজের কোনও স্তরই অবহেলার নয়। রাম দরিদ্রদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করে প্রমাণ করেছিলেন যে প্রকৃত সম্পর্ক গড়ে ওঠে হৃদয়ের বিনিময়ে, সম্পদের বিনিময়ে নয়।

আজকের যুগে আমাদের এই শিক্ষাগুলি ভুলতে বসেছি। আমরা সমাজের নীচু স্তরের মানুষদের প্রতি অবহেলা দেখাই, তাঁদের ভালোবাসা এবং সম্মান দিতে পারি না। কিন্তু রামচন্দ্র আমাদের শেখান যে প্রতিটি মানুষই ঈশ্বরের সৃষ্টি, এবং তাঁদের সম্মান করাই প্রকৃত ধর্ম।

ধর্ম সেই পথ, যেখানে মানুষকে ভালোবাসা দেওয়া হয়।

শেষ কথা

রামচন্দ্রের জীবন আমাদের বলে যে সত্যিকারের ভালোবাসা শ্রেণির ভেদাভেদ মানে না। তাঁর বনবাসে তিনি যেভাবে দরিদ্র শ্রেণির মানুষের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে তুলেছিলেন, তা আমাদের জীবনেও একটি বড় শিক্ষা।

আজ আমরা যদি রামের এই শিক্ষাগুলি নিজেদের জীবনে প্রয়োগ করি, তাহলে সমাজে সত্যিকারের সৌভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পারব।

শুধু ভগবান রামের নাম মুখে নেওয়া নয়, তাঁর জীবন থেকে শিক্ষা নিয়ে সেটিকে জীবনে বাস্তবায়িত করাই আমাদের প্রধান

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top